Slide Left Slide Right
News Image
News Image
News Image
OPINIONS

Published :

<span class="center">মানুষ অকারণে কেন </span> <span class="center">পশুপাখি হত্যা করে?</span>

ঘুরতে ঘুরতে পঞ্চগড়ে এসেছিল বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী নীলগাইটি। কিন্তু স্থানীয় কিছু মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই তাকে মেরে আহত করেছিল। উদ্ধার করে নীলগাইটি ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। প্রাণীটির চারটি পাসহ শরীরে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন ছিল। ক্ষতস্থানে জীবাণু আক্রমণের ফলে নীলগাইটি রোগ প্রতিরোধের শারীরিক সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে, ফলে সে মারা যায়।

নীলগাই বিলুপ্ত প্রজাতির একটি বন্যপ্রাণী। এটি গাই হিসেবে পরিচিত হলেও নীলগাই গরু শ্রেণির নয়। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ হরিণ শ্রেণির প্রাণী এটি। ২০১৫ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশের লাল তালিকায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ৩১ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি নীলগাই। সেই প্রাণীটি যখন সীমান্ত পার হয়ে এদেশে এলো আমরা তাকে বাঁচতে দিলাম না।

কোনো কারণ ছাড়াই, শুধু অবদমিত হিংস্রতা থেকে, আমরা এমন একটি প্রাণীকে পিটিয়ে আহত করলাম, যারা বাসস্থান ও খাদ্যের অভাবসহ প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১৯৪০ সাল থেকে।

কিশোরগঞ্জের গোরখোদক মনু মিয়া গত পঞ্চাশ বছর ধরে তিন হাজারের বেশি মানুষের কবর খুঁড়েছেন। কেউ মারা গেছে শুনলেই প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে ছুটে যেতেন কবরস্থানে। কিন্তু মনু মিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতেই কে বা কারা তার সেই ঘোড়াটি হত্যা করলো। খবরটা পড়ার পর থেকে ভাবছি মনু মিয়ার সাথে কারও কি কোনো শত্রুতা ছিল? ঘোড়াটির কি কোনো অপরাধ ছিল? মনু মিয়ার সাথে কারও কোনো শত্রুতা থাকার কথা নয়। একজন গোড়খোদকের সাথে কীসের শত্রুতা? কিন্তু এরপরেও তার নির্দোষ প্রাণীটি কেন মানা হলো?

মনু মিয়ার কাছে ঘোড়াটা ছিল সন্তানের মতো। মনু মিয়াকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কেউ হয়তো এমনটা করেছে। মানুষের মনে যখন হিংসা ও বিদ্বেষ ভর করে, তখন মানুষ দানব হয়ে যায়। যার প্রতি হিংসা ও ক্রোধ জন্ম নেয় তার ভালোবাসার ধন, সম্পত্তি, পশুপাখি মেরে শান্তি পায়। সেদিন দেখলাম একজনের কলাবাগান কেটেকুটে তছনছ করেছে। আরেকজনের পুকুরের সব মাছ বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে। রাজশাহীতে একটি আম বাগানের প্রতিটি গাছ আমসহ উপড়ে ফেলা হয়েছে। এগুলো সবই হিংসার ফল। বাগানের মালিক হাউমাউ করে কাঁদছেন, এতেই হয়তো আনন্দ পাচ্ছে অসুস্থ মানসিকতার কোনো ব্যক্তি।

মানুষ অকারণে কেন পশুপাখি হত্যা করে বা তাদের সাথে নির্মম আচরণ করে, এ নিয়ে নানাধরনের আলোচনা করা হলেও, মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতার মাত্রা খুব কম। শুধু উৎসাহী জনতা নয়, প্রাণী ব্যবসায়ীরাও জেনে বুঝে পশুপাখির সাথে ক্রুর আচরণ করে বা ঠিকমতো তাদের যত্ন নেয় না। ইতিহাস বলে শুধু এই যুগেই নয়, হাজার হাজার বছর আগেও গৃহপালিত প্রাণীদের ওপর অত্যাচার করা হতো। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় হাজার বছর আগের গৃহপালিত প্রাণীর যে দেহাবশেষ পাওয়া গেছে, তাতেও অসংখ্য হাড়ের রোগের প্রমাণ রয়েছে। তাদের ওপর অত্যাচার করা হতো, ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না।

বিবর্তন তত্ত্বের জনক চার্লস ডারউইন বলেছেন, মানুষ এবং উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে মানসিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এর মানে হচ্ছে প্রাণিকুল যুক্তি দিতে পারে না, নিজের পক্ষে কথা বলতে পারে না কিন্তু তারা অনুভব করে, আনন্দিত হয়, কষ্ট পায়। তারা নিবেদিতভাবে মালিকের প্রতি দায়িত্বপালন করে। অথচ অসহায় বলে মানুষের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়। শুধু যে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পশুপাখি নিপীড়নের শিকার হয়, তা নয়। অনেক মানুষ তাদের পোষা প্রাণীদের প্রতিও খারাপ আচরণ করে। চিড়িয়াখানা, সার্কাস, সাফারি, খামার ও পেট শপে থাকা প্রাণীরা প্রায়ই রূঢ় আচরণের শিকার হয়।

পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের প্রতি সহিংসতার মধ্যে যোগসূত্র আছে। ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অন্যান্য শিল্পের তুলনায় কসাইখানায় কর্মরতদের মধ্যে সহিংস অপরাধের জন্য, ধর্ষণের জন্য এবং অন্যান্য যৌন অপরাধের কারণে গ্রেফতারদের সংখ্যা বেশি।

‘নরওয়েজিয়ান সেন্টার ফর ভায়োলেন্স অ্যান্ড ট্রমাটিক স্ট্রেস স্টাডিজ’র এক জরিপে বলা হয়েছে ‘প্রাণী নির্যাতন এবং শিশু নির্যাতনের মধ্যে যথেষ্ট মিল’ পাওয়া গেছে। যেমন জুস্যাডিজম। পোষা প্রাণী এবং ছোট প্রাণীদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস, ‘জুস্যাডিজম’ নামে পরিচিত। এটা মনোরোগ বিদ্যার লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। জুস্যাডিজম হলো পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা থেকে পাওয়া যৌন আনন্দ। এটি একধরনের প্যারাফিলিয়া বা যৌন বিকৃতি। যেখানে পশুদের নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষ যৌন উত্তেজনা লাভ করে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে তাদের পক্ষে মানুষের প্রতি হিংস্র হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এফবিআই দেখেছে যে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার ইতিহাস হলো এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা নিয়মিতভাবে সিরিয়াল ধর্ষক এবং খুনিদের রেকর্ডে দেখা যায়। স্ট্যান্ডার্ড ডায়াগনস্টিক এবং চিকিৎসা ম্যানুয়্যালে, প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে আচরণগত ব্যাধির জন্য একটি ‘ডায়াগনিস্টিক মানদণ্ড’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

তবে হেলেন গ্যাভিন ‘ক্রিমিনোলজিক্যাল অ্যান্ড ফরেনসিক সাইকোলজি’ (২০১৩) বইতে লিখেছেন: অপরাধী ও প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ কোন সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য নয়। সিরিয়াল কিলার ডেনিস নীলসেন ১৯৭০/৮০-এর দশকে কমপক্ষে ১৫ জনকে হত্যা করেছে। তাকে ১৯৮৩ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

প্রাক্তন এই সরকারি কর্মচারী উত্তর লন্ডনের বাড়িতে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। যাদের বেশিরভাগই গৃহহীন তরুণ সমকামী পুরুষ ছিল। অথচ এই নীলসেন তার বিশ্বস্ত সঙ্গী কুকুরটি খুব ভালোবাসো। গ্রেফতারের পর, নীলসেন কুকুরটিকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। কারণ কুকুরটিও পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

কিছু মানুষ মানসিক রোগে ভুগে থাকেন, যেমন অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, সাইকোপ্যাথি বা সিজোফ্রেনিয়া। এই ব্যাধিগুলো সহানুভূতি বা সামাজিক নৈতিকতার অনুভূতি কমিয়ে দিতে পারে। এই রোগে আক্রান্তদের কেউ কেউ সহজেই পশুপাখির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে ফেলতে পারে। দমন করে রাখা ক্রোধের কারণে কেউ কেউ পশুপাখির ওপর তাদের আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করে। পশুরা প্রায়শই সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে, কারণ তারা দুর্বল ও প্রতিরোধ করতে পারে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা শৈশবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে বা ট্রমায় ভুগেছে বা পশু নির্যাতনের সাক্ষী হয়েছে, তারা পরবর্তী জীবনে এই নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে। এটি ‘দেখে শেখা আচরণ’ হিসেবে কাজ করে। শিশুরা যদি দেখে যে পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা করলে কেউ বকে না বা কারও শাস্তি হয় না, তখন তারা এটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, পারিবারিক সহিংসতা রয়েছে, সেইসব পরিবারের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে, একটি শিশু কোনো না কোনো পশুকে আহত করেছে বা মেরে ফেলেছে।

মানুষ যে কোনো কারণ ছাড়াই পশুপাখি হত্যা করে, এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়ে নীলগাইকে পিটিয়ে আহত করা ছাড়াও, সিলেটের কিছু তরুণ টিলার ওপরে আশ্রয় নেওয়া শিয়াল, বাগডাসকে হত্যা করলো, বনবিড়ালের চামড়া নিয়ে মিছিল করলো। বন্যার সময় ঘরে আশ্রয় নেওয়া হরিণটি খেয়ে ফেললো। আরেকটি গ্রুপ গন্ধগোকুল শিশুদের নিরাশ্রয় করে তাদের মাকে মেরে ফেলল। যারা কুকুরের হাত-পা ভেঙে দিলো, বিড়ালকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিলো, আহত শামুকখোল পাখিদের রান্না করে খেলো, বিষ খাইয়ে মাছ, বানর ও পাখি মেরে ফেললো, এরা আসলে খুনি। এরা বিনা প্রয়োজনে পশুপাখি খুন করতে পারে, কালকে মানুষও খুন করবে। এর প্রমাণ আমরা এখন প্রতিদিন দেখছি। কারণে-অকারণে মানুষ মানুষকে খুন করছে।

মনোবিজ্ঞানে একটি তত্ত্ব রয়েছে, যাকে বলা হয় "The Link“ এই লিংক তত্ত্ব অনুযায়ী পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণ, মানুষের প্রতি হিংস্র আচরণের সাথে সম্পর্কিত। যারা পশু নির্যাতন করে, পরে মানুষের প্রতিও হিংস্র আচরণ করার আশঙ্কা তাদের মধ্যেই বেশি থাকে। অনেক সিরিয়াল কিলারের শৈশবে পশু নির্যাতনের ইতিহাস আছে।

পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণের পেছনে মানসিক সমস্যা বা হিংস্র মনোভাব একটি গুরুতর বিষয়। এটা শুধু পশুদের ক্ষতি করে না, বরং সমাজে বড়ধরনের হিংস্রতারও ইঙ্গিতও দেয়। এটি প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং আইনি ব্যবস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। কুকুর, বিড়াল ও বিভিন্ন প্রাণীর ওপর নির্যাতনকারী মানসিক রোগীদের ওপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাদের সবারই মানুষের প্রতি ক্রোধ ও ক্ষোভ ছিল। এদের মধ্যে এমন একজন মানসিক রোগীও ছিল, যে একটি ছোট ছেলেকে হত্যা করেছিল।

ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের আচরণগত বিজ্ঞান ইউনিটের একজন সদস্য রবার্ট কে. রেসলার সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই ধরনের খুনিরা ছোটবেলায় প্রাণীদের হত্যা এবং নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার কাজটি শুরু করে। অ্যান্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সহানুভূতির অভাব থাকে। অনেক সময় পশুদের আঘাত করা তাদের কাছে ক্ষমতা প্রদর্শনের বা মানসিক চাপ কমানোর একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে রাস্তায় কুকুর ও বিড়ালকে লাথি মারা, পাথর ছুড়ে মারা, গরম পানি ঢালা বা বিষ প্রয়োগে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছেই। কাঁটাবনের পোষা প্রাণীর বাজারে গেলে বোঝা যায় সেখানে কতটা মানবেতর পরিবেশে পশুপাখিদের রাখা হয়েছে। কোভিডকালে সেখানে অসংখ্য প্রাণী নিহত হয়েছে। এখনো পশুপাখিগুলো ধুঁকছে।

চিড়িয়াখানাও একটি বন্দিশালা। এখানে পশুদের অযত্ন, অপুষ্টি, তৃষ্ণা বা অপরিচ্ছন্নতার কারণে কষ্ট পেতে দেখা যায়। কক্সবাজার ও গুলিস্তানে যে ঘোড়ার গাড়িগুলো চলে তাদের মালিক/চালকরা ঘোড়ার প্রতি অমানবিক আচরণ করে। ঘোড়াগুলো অতিরিক্ত ভার বহন করতে বাধ্য করা হয়, তাদের মারধর করা হয় ও খাওয়ার কষ্ট দেওয়া হয়।

পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা না থাকলে শিশু কঠিন মন নিয়ে বড় হয়। প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি ও সচেতনতার অভাব, নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি এবং নির্মম আচরণ শিশু-কিশোরদের মধ্যে সহিংস আচরণ বাড়িয়ে তোলে। শিশু-কিশোর যদি প্রকৃতি, পশুপাখি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসাহীনতা নিয়ে বড় হয়, তাহলে তারা কখনো পরিবার, সমাজ ও দেশকে ভালোবাসতে পারবে না। এই ফল যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমরা দেখছি।

<span class="bold">লেখক : শাহানা হুদা রঞ্জনা</span>

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

সূত্র : <a class="link" href="https://www.jagonews24.com/opinion/news/1025175">জাগো নিউজ</a>

News Image
News Image
News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

Public Figures

Slide Left Slide Right
News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image