Slide Left Slide Right
News Image
News Image
News Image
বিশেষ সংবাদ

Published :

<span class="center">বেদেদের ছন্নছাড়া জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া </span>

মোরা এক ঘাটেতে রান্দি বাড়ি, আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই, পথে ঘাটে ঘুরে মোরা সাপ খেলা দেখাই, মোদের ঘর বাড়ি নাই। বিখ্যাত সুরকার আবু তাহের “বেদের মেয়ে জোসনা” ছবির গানের মধ্যে বুঝিয়েছেন যে, যাযাবর মনবগোষ্ঠীগুলোকে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাই সে হলো বেদে পরিবার।

একদল রহস্যময় মানুষ। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে ওরা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেখা যায় এদের। দেশে দেশে বা অঞ্চলভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্র সব পেশা। নর-নারী, শিশুর অদ্ভুত তাদের চেহারা, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা। বেদে মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন তাই হয়ে ওঠে নৌকা। নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ-দেশান্তরে। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্রময়।

বেদেরা জীবনকে এক ঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে। প্রকৃতির মাঝেই এরা জীবনের বৈচিত্র্যের সন্ধান খোঁজে। বেদেদের এই সন্ধানই আমাদের লোকসাহিত্যেও অন্যতম উপজীবী অংশ বেদে সম্প্রদায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসংকুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। এরা মূলত আমাদের দেশে বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমান জনগোষ্ঠী।

তবে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন বদলে দিয়েছে বেদে পল্লীর জীবন। বগুড়ায় মাটিডালি বিমান মোড় ২য় বাইপাস করতোয়া নদীর পূর্বপাশে^ বেদে পল্লীতে বর্তমানে যুগের আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তাদের বহরে যোগ হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির তৈরী সোলার প্যানেলের বাতি। বিষয়টি নিয়ে সবার মাঝে কৌতুহলের শেষ নেই। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া বদলে দিয়েছে তাদের জীবনমান। স্মার্ট ফোনের ব্যবহার, ব্যাটারী দিয়ে খুপড়ি ঘরে সাউন্ড বক্স চালানো, আর সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার আলোকিত করছে তাদের অবহেলিত জীবনকে। অথচ এক সময়ে চেরাগের (কুপির),হারিকেনের আলো ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির প্রায় ২০ থেকে ২৫টি ঘরে ৬০ জন পরিবার নিয়ে বেদে সদস্য বসবাস। আগের জীবনে অন্ধকারে এ ঘাট ছেড়ে অন্যঘাটে বসবাস করলেও বর্তমানে তাদের ভিতরে এসেছে আধুনিকতার ছোয়া।

বেদে সম্প্রদায় নিয়ে রয়েছে নানা রহস্যময় কথা। এদের ইতিহাস খুঁজলে তেমন কোনো লিখিত দলিল পাওয়া যায় না। রহস্যময় তাদের এই জীবনধারা। যুগ যুগ ধরে বংশ-পরম্পরায় ঘিরে সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্যের বিকাশ ঘুটিয়েছে। যা আমাদের বাঙালি লোকসাহিত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মূলত এরা যাযাবর জাতি কিন্তু আশ্চর্য এক সত্য হলো এরা তাদের জীবনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তেমন কিছু ধারণা দিতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে বংশপরস্পরায় দাদা-পরদাদা থেকে যা শোনে তা-ই তার বলেতে পরে। আমাদের দেশে প্রবল বিরুদ্ধ স্রােতে এখনও টিকে আছে বেদেরা।

সময়ের প্রভাবে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীকুক্ত হয়ে বাস করে এরা। বেদে নারীরা সমাজ মাতৃতান্ত্রিক বেদে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে উপার্জন বিয়ে ও সন্তান প্রতিপালনে তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বেদে পুরুষরা অলস হয়। কায়িক পরিশ্রমকে তার ঘৃণা করে। ফলে সংসারের ব্যয় নির্বাহরে জন্য বেদে মেয়েদেররই বের হতে হয়।

বেদে পল্লীর নারী সদস্য সাথী বলেন, সৌরবিদ্যুৎতের সোলার টা বের হবার পর আমরা অনেক কষ্ট করে কিনার পর আমরা সৌর বিদ্যুৎতের সোলার দিয়ে আমরা লাইট, ফ্যান, মোবাইল র্চাজসহ আমরা অনেক কাজেই ব্যবহার করতে পারছি। সোলার আসাতে আমাদের বেদে পল্লীর জন্য অনেক উপকার হয়েছে। আগে মনে করেন নৌকার চলছি অনেক কষ্টে চলছি কোন জায়গায় তেল পাওয়া গেছে, কোন জায়গায় তেল পাওয়া যায়নি। অনেক সময় আমরা হারিকেনের বাতি জ¦ালিয়ে, কুপির বাতি জ¦ালিয়ে চলছি। এখন সোলার বিদ্যুৎ আসার পর অনেক শান্তিতে আছি। চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রিসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজস্ব ভাবধারায় রচিত হতো বেদেদের জীবন।

কিšু‘ এখন আগের চেয়ে গ্রাম গঞ্জের মানুষ অনেক সচেতন যার কারণে বেদে পল্লীতে আগের মতো চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রি করে বেশি আয় করা যায় না। গত দুই দশক আগেও আমাদের বেদেদের যে অবস্থা ছিলো, আজ তা নেই। আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের সমস্ত জীবন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। যাযাবর বৃত্তি পরিহার করে স্থায়ী বসতির চিন্তা এখন সব বেদেদের স্বপ্ন হলোও বর্তমান সচেতন সমাজে বেদে পল্লী পরিবারে স্বপ্ন পূর্রণে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন সাথী।

সাথী আরো বলেন, সকাল হলেই আমি গাঁ করতে যাই চিনামাটির থালা বাসন বিক্রি করে দুই-তিনশ টাকা আয় হলেও বর্তমানে বাজারে সব জিনিসের যে, দাম চাল ডান কিনে ডাল ভাত খেতেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে দেশ ছেড়ে ভিন দেশে এসে আয় করমো কি আর খামু কি বলেন ।

ঢাকা বিক্রমপুর লৌংগঞ্জ থানার বাসিন্দা বেদে পরিবারের সদস্য মাজাহারুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইল থেকে মাস খানিক ধরে আমরা বগুড়ায় মাটিডালি বিমান মোড় ২য় বাইপাস করতোয়া নদীর পূর্বপাশে^ এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছি। এখানে আমাদেরও মাস খানিক চলছে আর কিছু দিন পারে এখান থেকে আমার কুষ্টিয়া জেলায় যাব। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎতের সোলারে বাতি জ¦ালিয়ে আমরা সংসারে কাজ করতে অনেক সুবিধা হয়েছে। আগে আমরা কেরোসিনের তেল পুড়িয়ে বাতি জ¦ালাতাম। সোলার আসার পরে আর তেল পুড়িয়ে বাতি জ¦ালাতে হয় না। তাদের অনেকেই এখন আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি হয়ে বসবাস করতে চায় না। এরই রেশ ধরে তাদের ঘরে এখন জ্বলছে আধুনিক প্রযুক্তির তৈরী সোলার বাতি আর ফ্যানের বাতাস ।

ঢাকা বিক্রমপুর মুন্সিগঞ্জ জেলার বেদে পরিবারের সদস্য আকাশ ইসলাম বলেন, আমরা আগের মতো করে চলতে পারি না। আধুনিকাতার ছোয়া বেদে পল্লীতে দেখা গেলেও আয় - রোজগার কম হওয়ায় অনেক কষ্ট করে চলতে হয় আমাদের। আমার ঘরে তিন ছেলে আর এক মেয়ে তাদের নিয়ে আমার পরিবার ঝাড়-ফুকঁ আর বাত ব্যথার ওষুধ বিক্রি করে চলে না দাদা । আর বেশি দিন এই পেশায় কাজ করা যাবে না। বাপ দাদার করে গেছে তাই করছি ।

বেদে পরিবারের আর এক সদস্য আকাশ বলেন, সোলারবিদ্যুতের অনেক সুবিধা পাচ্ছি আমরা মনে করেন, সারাদিন কাজ করে এসে আমরা মোবাইলে র্চাজ দিতে পারি, ব্যাটারি দিয়ে ঘরে সাউন্ড বক্স বাজাতে পারি, ফ্যান চালাতে পারি, লাইট জ¦ালাতে পারি। তাই এখনও আধুনিকতার ছোয়ায় বেদেদের জীবনে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও এ সম্প্রদায়ের জীবন অমানবিক। তারা এখনও মূলস্রোত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, নেই নাগরিক অধিকার। তাদেরকে পেশা পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে পারলে তারা মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারবে। তাদের কেই আর খোঁজ নেয় না অমানবিক জীবন থেকে মুক্তি পাবে তারা।

বেদেরা আমাদের দেশের অন্যতম সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে এদের সংখ্যা প্রায় ৬৩টি লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ এবং হরিজন ১৫ লাখ। বাংলাদেশের বেদেরা মোট নয়টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিকর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, ম্লেছ, বান্দাইরা, মাল এবং সাপুড়িয়া। এরা সকলেই জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করেন। এদের পেশা হলো চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রি। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে ও নানারকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়বাকড় এরা ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করেন। এদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড়ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। এসময় বেদেরা বেশ সাজগোজ করে কোমরে বিছা আর গায়ে ইমটেশন গহনা পরে। খোপায় ফুল গুজে রাখে মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই তাদের এমন সাজগোজ।

তাবিজ-কবজ বিক্রি, জাদুটোনা আর সাঁপ খেলা দেখিয়ে যাদের জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা সেই ছিন্নমূল, অসহায় ও অধিকার বঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়। যারা রাস্তার পাশে, ফাঁকা মাঠে বা পরিত্যক্ত জমি, খাসজমি, রাস্তার ধার, স্কুলের মাঠে রেললাইনের পাশে অথবা নদীর তীরে অতিথি পাখির মত অস্থায়ী আবাস গড়ে। আবার একদিন উধাও হয়ে যায়, কেউ খবর রাখে না তাদের। কোথায় গেল? তারা যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায় আচ্ছন্ন তার খবর রাখার কেউ থাকে না।

সময়ের আবর্তে উন্নতির পরিবর্তে বেদে সমাজের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। নদীর রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চলার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। আর তাই তারা অনেকেই ছাড়তে শুরু করেছে নদী। নদী ছেড়ে কোথায় যাবে এই বেদেরা। তাদের নেই কোন শিক্ষা, নেই কোন কাজের বিশেষ যোগ্যতা। বাংলাদেশের সমাজে শ্রেণি বিভাজন না থাকলেও বেদেদের দেখা হয় কিছুটা আলাদা চোখে। আর তাই সমাজের মূলস্রোতে মেশাটাও খুব একটা সহজ নয় তাদের জন্য। তবে বেদেরা হারিয়ে গেলে বাংলাদেশের পুরাতন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ হারিয়ে যাবে। কারণ তারা যাযাবর একটি উপজাতি হলেও কোনভাবেই মূল বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

বগুড়া সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সমর কুমার পাল বলেন, আচরণে ও পেশায় ভিন্নতা থাকলেও বেদেরা এ দেশেরই নাগরিক। তারা পেশার টানানে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াই । নির্দিষ্ট করে কোথাও না থাকার কারণে আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে পারি না । তারা যদি কোথাও স্থায়ী ভাবে বসবাস করতো তাহলে আমরা তাদেকে সাহায্য করতে পারব ।

News Image
News Image
News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

Public Figures

Slide Left Slide Right
News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image

News Image